নিম

neem

প্রচলিত নাম- নিম

ইউনানী নাম- নীম

আয়ুর্বেদিক নাম- নিম্ব

ইংরেজী নাম- Neem tree

বৈজ্ঞানিক নাম- Azadirachta indica A. Juss

পরিবার- Meliaceae

কথায় আছে একটি বাড়ীতে যদি নিম গাছ থাকে তবে ঐ বাড়ী থেকে রোগ বালাই দূরে থাকে। এমনকি পোকা- মাকড় ও সে বাড়ীতে কম দেখা যায়। এখনও বাংলাদেশের বড় বড় গৃহস্থদের বাড়ীতে ধান থেকে চাউল করার পর চাউলের ডোলে নিম পাতা দিয়ে রাখা হয়, যেন চাউলে পোকা আক্রমন না করে, এ পদ্ধতিটি পরীক্ষিত। এর আরও বহু গুনাগুন লোকে মুখে শোনা যায় প্রত্যহ নিমের পাতার রস এক কাপ করে খেলে চর্ম রোগ, কৃমি নিরসন ও জ্বর থেকে উপশম পাওয়া যায়। 

নিম গাছ বাংলাদেশের প্রায় সবখানে পাওয়া যায়, বৃহদাকারের বৃক্ষ। মার্চ- এপ্রিল মাসের দিকে ফুল হয়। ফুল শ্বেতবর্ণ এবং ফল কাঁচা অবস্থায় সবুজ, পাকলে পীতবর্ণ বা হলুদ বর্ণ ধারণ করে। 

নিমে যে সমস্ত রাসায়নিক উপাদান পাওয়া যায়- পাতা, ছাল, ফুল, ফল ও বিচির তেলে প্রচুর সংখ্যক তিক্ত উপাদান যেমন, নিম্বিন, নিম্বিডিন, নিম্বিনিন ইত্যাদি টাপ্রিনিয়েড, গ্লাইকোসাইড, অ্যালকালয়েড ও ট্যানিন বিদ্যমান।

নিমের যে সমস্ত অংশ ব্যবহার করা হয়- ফুল, পাতা, ছাল, ফল বা বীজ ও তেল।

নিমের গুনাগুন- রক্ত পরিস্কারক, চর্মরোগ নাশক, ব্রণ, কৃমি, কুষ্ঠ ও ক্ষত নিবারক, শরীরের জ্বালা পোড়া, এলারজি এবং মুখের দুর্গন্ধ নাশক, দাঁতের মাড়ি সবল কারক।



নিমের ঔষধি গুনাগুণ

নিমের ফুল, পাতা ,বাকল তেল ব্যবহার করে মানুষের প্রায় ১০০ রোগের চিকিৎসা করা হয়। যেমন-

  • ম্যালেরিয়াঃ নিম পাতার নির্যাস ব্যবহারে ম্যালেরিয়া প্রশমিত হয়। পানি বা এলকোহল মিশ্রিত নিম পাতার নির্যাস ব্যবহারে একই ধরনের ফল পাওয়া যায়
  • মানসিক চাপ অশান্তিঃ অল্প পরিমাণ নিম পাতার নির্যাস খেলে মানসিক চাপ মানসিক অশান্তি কমে যায়
  • জন্ম নিয়ন্ত্রণঃ নিম পুরুষ মহিলা উভয়েরই জন্ম নিয়ন্ত্রণের ঘটক (Agent) হিসেবে কাজ করে। সহবাসের পূর্বে নিম তেল তুলায় ভিজিয়ে স্ত্রী যৌন অঙ্গে ১৫ মিনিট রাখলে স্পার্ম মারা যায়। নিম লিফ টেবলেট পুরুষের জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
    প্রতিদিন এক মুঠো নিম পাতা খেলে গর্ভধারণ হয় না। সপ্তাহ পুরুষ নিম তেল সেবনে স্ত্রী গর্ভবতী হয় না
  • আলসারঃ নিম পাতার নির্যাস নিম বীজ হতে নিম্বিডিন নির্যাস খেলে পেপটিক ডিওডেনাল আলসার উপশম হয়
  • ব্রণঃ নিম পাতা পিষ্ট করে মধুর সাথে মিশিয়ে প্রলেপ দিলে ব্রণ সেরে যায়
  • জন্ডিসঃ ২৫-৩০ ফোঁটা নিম পাতার রস একটু মধুর সাথে মিশিয়ে সকালে খালি পেটে খেলে জন্ডিস আরোগ্য হয়
  • বহুমূত্র রোগঃ প্রতিদিন টেবিল চামচ নিম পতার রস সকালে খালি পেটে মাস খেলে ডায়বেটিস আরগ্য হয়। প্রতিদিন সকালে ১০টি নিম পাতা গুড়া বা চিবিয়ে সেবন করলে ডায়বেটিস ভাল হয়। নিম পাতার রস খেলে ৩০-৭০% ইনসুলিন নেয়ার প্রবণতা কমে যায়
  • বসন্তঃ কাঁচা হলুদের সাথে নিম পাতা বেটে বসন্তের গুটিতে দিলে গুটি দ্রুত শুকিয়ে যায়
  • রাতকানাঃ নিম ফুল ভাজা খেলে রাতকানা উপশম হয়
  • চোখের ব্যথাঃ নিম পাতা সামান্য শুস্ক আদা সৈন্ধব লবণ একত্রে পেষণ করে সামান্য গরম করে একটি পরিস্কার পাতলা কাপড়ে লাগিয়ে তা দ্বারা চোখ ঢেকে দিলে চোখের স্ফীতি ব্যথা সেরে যায়
  • লাল মেহরোগঃ নিম মূলের ছালের রস কাঁচা দুধ মিশিয়ে কিছুদিন খেলে লাল মেহরোগ উপশম হয়
  • মাথাধরাঃ নিম তেল মাখলে মাথা ধরা কমে যায়
  • ক্যান্সারঃ নিম তেল, বাকল পাতার নির্যাস ব্যবহারে ক্যান্সার-টিউমার, স্কীন ক্যান্সার প্রভৃতি ভাল হয়
  • উকুনঃ নিমের ফুল বেটে মাথায় মাখলে উকুন মরে যায়
  • হৃদরোগঃ নিম পাতার নির্যাস খেলে হৃদরোগে উপকার পাওয়া যায়। নিম নির্যাস ব্লাড প্রেসার ক্লোরেস্টোরল কমায়। রক্ত পাতলা করে, হার্টবিট কমায়
  • কৃমি নিরসনঃ -৪গ্রাম নিম ছাল চূর্ণ সামান্য পরিমাণ সৈন্ধব লবণসহ সকালে খালি পেটে সেবন করে গেলে কৃমির উপদ্রব হতে রক্ষা পাওয়া যায়। নিয়মিত এক সপ্তাহ সেবন করে যেতে হব। বাচ্চাদের ক্ষেত্রে - গ্রাম মাত্রায় সেব্য
  • রক্ত পরিস্কার চর্ম রোগঃ কাঁচা নিম পাতা ১০ গ্রাম কাপ পানিতে জ্বাল করে (এক) কাপ অবশিষ্ট থাকতে ছেঁকে নিয়ে প্রয়োজন মতো চিনি মিশিযে সেব্য।
    উল্লেখিত নিয়মে প্রত্যহ - বার, নিয়মিত - মাস সেবন করে যেতে হবে
  • দাঁতের যত্নঃ কচি নিম ডাল দিয়ে দাঁত মাজলে দাঁত ভাল থাকে। নিম পাউডার দিয়ে দাঁত মাজলে দাঁত মাঁড়ি ভাল থাকে। নিম পাতার নির্যাস পানিতে মিশিয়ে বা নিম দিয়ে মুখ আলতোভাবে ধুয়ে ফেললে দাঁতের আক্রমণ, দাঁতের পচন, রক্তপাত মাড়ির ব্যথা কমে যায়
  • স্বপ্নদোষ প্রশমনঃ নিম ছালের রস - চা চামচ (এক) গ্লাস পরিমাণ গরুর দুধে মিশিয়ে রাত্রে শয়নকালে সেবন করলে স্বপ্নদোষ প্রশমিত হয়
  • খোস-পাঁচড়া পুরনো ক্ষতঃ নিম পাতার সাথে সামান্য কাঁচা হলুদ পিষে নিয়ে আক্রান্ত স্থানে প্রলেপ আকারে -১০ দিন ব্যবহার করলে খোস-পাঁচড়া পুরনো ক্ষতের উপশম হয়। নিম পাতা ঘিয়ে ভেজে সেই ঘি ক্ষতে লাগালে ক্ষত অতি সত্বর আরোগ্য হয়
  • বমিঃ বমি আসতে থাকলে নিম পাতার রস - ফোঁটা দুধ দিয়ে খেলে উপশম হয়





ত্বকের সুরক্ষায় নিম পাতা




মুখে একটু ব্রণ হলে বা ত্বকের কোন সমস্যা হলেই আমাদের দুশ্চিন্তা শুরু হয়ে যায় এই দুশ্চিন্তায় দুশ্চিন্তায় একটা ব্রণের জায়গায় আমরা দুই তিনটি ব্রণ বানিয়ে ফেলি অথচ হাতের কাছেই প্রাকৃতিক উপাদান নিমপাতা আমাদের এক্ষেত্রে খুব সাহায্য করতে পারে নিমপাতার ব্যবহার অনেক প্রাচীণ বিধায় অনেকেই এর ব্যবহার জানেন কিন্তু এত এত কস্মেটিকের ছলনায় আমরা আসলেই কি এর কথা মনে রেখেছি? আসুন জেনে নেই তিতা নিমের মধুর গুণের কথা এবং এর ব্যবহারঃ

০১. নিমপাতা ফাঙ্গাস ব্যাকটেরিয়া বিরোধী। তাই ত্বকের সুরক্ষায় এর জুড়ি নেই। ব্রণের সংক্রমণ হলেই নিমপাতা থেঁতো করে লাগালে ভালো ফল নিশ্চিত

০২. মাথার ত্বকে অনেকেরই চুল্কানি ভাব হয়, নিমপাতার রস মাথায় নিয়মিত লাগালে এই চুলকানি কমে, চুল শক্ত হয়, চুলের শুষ্কতা কমে যায় এবং চুল গজানো তরাণ্বিত হয়

০৩. শুধুমাত্র চুলের নয় ত্বকের চুলকানিতেও নিমপাতা বেটে লাগালে উপকার পাওয়া যায়

০৪. নিয়মিত নিমপাতার সাথে কাঁচা হলুদ পেস্ট করে লাগালে ত্বকের উজ্জলতা বৃদ্ধি স্কিন টোন ঠিক হয়। তবে হলুদ ব্যবহার করলে রোদ এড়িয়ে চলাই ভালো। নিমপাতার চেয়ে হলুদের পরিমাণ কম হবে

০৫. নিমের তেলে প্রচুর ভিটামিন এবং ফ্যাটি এসিড থাকে যা ত্বক এবং চুলের জন্য উপকারী

০৬. নিমের পাতা খেলে আমাদের শরীরের আজেবাজে জিনিস ভালো হয়ে যায় মানে শরীরের পরিপাক তন্ত্রের গতি বাড়ে সেই সাথে বিষাক্ত পদার্থ দূর করে দেয় এবং রক্তের শুদ্ধতা বাড়ায়, ফলাফল হিসেবে শরীরের কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হয়ে আপনার ত্বক পরিষ্কার থাকবে। জন্য নিমের পাতা / টি প্রতিদিন চিবিয়ে খেতে হবে। উফফ!! মুখটি কি এখনি তেতো হয়ে গেলো?? আরে সহজ সমাধান দেইনিমপাতা বেটে ছোট ছোট বড়ি তৈরি করে রোদে শুকাতে দিন। ভালো ভাবে শুকিয়ে গেলে কাঁচের বয়ামে সংরক্ষণ করুন। প্রতিদিন সকালে / টি বড়ি পানি দিয়ে পেটে চালান করে দিন

০৭. নিমপাতা সেদ্ধ পানি গোসলের পানির সাথে মিশিয়ে নিন। যাদের স্কিন ইরিটেশন এবং চুল্কানি আছে তাদের এতে আরাম হবে আর গায়ে দুর্গন্ধের ব্যাপারটাও কমে যাবে আশা করা যায়

০৮. নিমপাতা সেদ্ধ পানি বোতলে ভরে ফ্রিজে রেখে দিতে পারেন। কোন ফেসপ্যাক পেস্ট করার সময় পানির বদলে এই নিম পানি ব্যবহার করতে পারেন

০৯. নিমের ডাল যে দাঁতের জন্য উপকারী সে কথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। মুখের দুর্গন্ধ দাঁতের জীবাণু রোধে এটি বেশ কার্যকরী

১০. কাটা ছেড়া বা পোড়া স্থানে নিম পাতার রস ভেষজ ওষুধের মতো কাজ করে

১১. নিম পাতা রোদে শুকিয়ে গুঁড়ো করে রেখে দিতে পারেন পরবর্তীতে ফেস মাস্ক হিসেবে ব্যবহার করার জন্য

আসলে তিতা নিমের গুণের কথা বলে শেষ করা যাবে না, তাই আজকে আপনাদের একটা নিমের চা এর রেসিপি দিয়ে লেখা শেষ করছি। এমনিতেই ভেষজ চা অনেক উপকারী আর নিজেকে সতেজ সুস্থ রাখতে নিম চা এর তুলনা হয় না। যারা ইতিমধ্যে চিরতার রস খেয়ে অভ্যস্থ তাদের কাছে নিম চা দুধভাত মনে হবে। যারা নতুন তারা মধু মিশিয়ে নিতে পারেন

নিম চাঃ

শুকনো নিম পাতা গুঁড়ো অথবা তাজা নিমের / টি পাতা গরম পানিতে ছেড়ে / মিনিট জ্বাল দিয়ে মধু মিশিয়েই বানিয়ে ফেলা যায় সুমিষ্ট নিম চা , তবে নতুনদের জন্য সময়সীমা মিনিট। যত বেশি জ্বাল দিবেন তত তিতা হবে




নিম পাতা যে উপকারী তা আমরা সবাই জানি এটি প্রায় হাজার বছরের বেশী সময় ধরে উপমহাদেশের আয়ুবের্দ চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়ে আসছে তবে রূপচর্চায়ও এর ব্যপক ব্যবহার রয়েছে নিমপাতার গুণে মুগ্ধ হয়ে পশ্চিমারাও আজকাল ঝুঁকে পড়ছে ভেষজ আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় আজকে জেনে নিন রূপচর্চাসহ এর বহুবিধ কিছু ব্যবহার
স্কিন টোনার
নিমপাতা স্কিন টোনার হিসেবেও ব্যাবহার করা যায় প্রতিরাতে তুলার নরম বল নিমপাতা সেদ্ধ পানিতে ভিজিয়ে মুখে লাগাতে হবে এতে ব্রণ, ক্ষত চিহ্ন, মুখের কালো দাগ দূর হবে একইভাবে চুলে ব্যাবহার করলে খুশকি এবং অতিরিক্ত চুল পড়া বন্ধ হবে
ফেসপ্যাক
১০টি নিমপাতা একটি ছোট কমলা খোসা ছাড়িয়ে অল্প পরিমাণ পানিতে সিদ্ধ করতে হবে উপকরণগুলো মসৃণ করে পেস্ট তৈরি করতে হবে অল্প পরিমাণ মধু দুধ পেস্টে মেশাতে হবে ফেসপ্যাকটি সপ্তাহে তিনবার ব্যাবহার করা যাবে এটি ত্বকের ব্রুণ, কালো দাগ, চেহারায় ক্ষতের গর্ত দূর করবে মধু এবং নিম উন্নতমানের ময়শ্চারাইজার হিসেবে কাজ করে
কন্ডিশনার
নিমপাতা সিদ্ধ পানি মধুর একটি পেস্ট তৈরি করে চুলে লাগান এটি একটি ভালো কন্ডিশনার হিসেবে কাজ করে এছাড়া খুশকি দূর করতেও কাজে লাগে
পানি বিশুদ্ধকরণ
দুই লিটার পানির মধ্যে ৫০টি নিমপাতা সিদ্ধ করতে হবে পাতাগুলো নরম বিবর্ণ না হওয়া পর্যন্ত পানি ফুটাতে হবে পানি সবুজ রং ধারণ করলে নামিয়ে বোতলে ঢেলে রাখতে হবে প্রতিদিন গোছলের পানিতে ১০০মিলি পরিমাণের নিমপাতার পানি মিশিয়ে গোছল করলে চামড়ার ইনফেকশন দূর হবে এছাড়া ব্রণ এবং হোয়াইট হেডস দূর হবে
চিকিৎসা
শরীরে ব্যাথা, কেঁটে গেলে, পুড়ে গেলে, কান ব্যাথা, মচকানো, মাথা ব্যাথা, জ্বর কমাতে নিমপাতা ব্যাবহার করলে উপকার পাওয়া যায়
নিমের শিকড়
নিমগাছের বাকল শিকড় ঔষধি গুণসম্পন্ন চুলের উকুন খুশকি দূর করতে এসব ব্যাবহার করা যায় নিমপাতা ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধ করতে পারে চামড়ার ইনফেকশন রোধে এছাড়া ব্রুণ, চুলকানি এলার্জি রোধে নিমপাতা কার্যকর


2 comments: